‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’ পালন করল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, উন্মোচন করল ‘উঁকি’


তিনসুকিয়া : প্রতিবারের মতো এবারেও ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, বুধবার তিনসুকিয়ার উজান সাহিত্য গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানসূচীর মধ্যদিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করল। বিকেল তিনটায় ‘উজান’ সভাপতি শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ নিবেদনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন সেদিনের আমন্ত্রিত অতিথি-দ্বয় ড০ জ্যোতি প্রসাদ চলিহা, ড০ অভিজিৎ চক্রবর্তী সহ সমবেত লেখক, শিল্পী, কলাকুশলী এবং সমাজকর্মীরা। একই সঙ্গে তখন পরপর দুটি সমবেত সঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, এবং ‘চিরচেনেহি মোর ভাষা জননী’ পরিবেশন করেন শিল্পীরা। 
প্রথম সঙ্গীতের শিল্পীরা সবাই উজানের সদস্য-সদস্যা। তাঁরা ছিলেন ক্রমে বর্ণালি সেনগুপ্ত, শীলা দে সরকার, গীতা ভৌমিক, শিল্পী চক্রবর্তী, মিতালি মালাকার। তবলাতে সঙ্গত করেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, দ্বিতীয় সঙ্গীতের শিল্পীরা ছিলেন কামিনী কুমার গোঁহাই, মঞ্জুরি শর্মা ফুকন, ইন্দিরা গোঁহাই, ভৈরবী দহোতিয়া, লক্ষ্মীপ্রিয়া বরঠাকুর, রীতা শর্মা, কাবেরী বরকটকী, পদুমী বরঠাকুর। তাঁদের তবলাতে সহযোগিতা করেন তরুণ চলিহা। এর পর সভাপতি আসন গ্রহণ করলে এবং অতিথি-দ্বয়কে সরাই, উত্তরীয় এবং সঞ্জয় চক্রবর্তী ও প্রসূন বর্মণ সম্পাদিত, অক্ষর প্রকাশিত ‘আধুনিক অসমিয়া কবিতা’র বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ উপহার স্বরূপ দিয়ে বরণ করা হয়। তখন আবার উজানের শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘শুভ কর্মপথে’ শীর্ষক রবীন্দ্র সঙ্গীতটি। সভাপতি সুজয় রায় এর পরে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন। এর পরে অতিথিরা উন্মোচন করেন একটি পুস্তিকা ‘উঁকি’। 
২০১৬র ডিসেম্বরে উজানের উদ্যোগে তিনসুকিয়াতে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বাংলা ছোট পত্রিকা সম্মেলনের প্রতিবেদন এবং স্মৃতিকথা নির্ভর এই পুস্তিকাটি সম্পাদনা করেছেন সুশান্ত কর, সুজয় রায় এবং সবিতা দেবনাথ। অনুষ্ঠানের সূচনাতে নীলদীপ চক্রবর্তী, অমিয় লাহন, অতুল শর্মা এবং নিশা গুপ্তা। এর পরে ‘জীৱিকাৰ সন্ধানত মাতৃভাষা’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন লেখক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মী, তথা তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ড০ জ্যোতি প্রসাদ চলিহা। 
ঔপনিবেশিক ভারতে কীভাবে ইংরেজি রাষ্ট্রে এবং দেশীয় সমাজেও একটি প্রতাপের ভাষাতে পরিণত হয়ে, কোন বাস্তবতাতে নয়া ঔপনিবেশিক দেশেও আধিপত্যটি টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশীয় ভাষাগুলোকে বিপন্ন করে চলেছে তিনি সরল যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চিন জাপান লাতিন আমেরিকা সহ ইউরোপীয় বহুদেশের দিকে তাকালেও স্পষ্ট হয় যে আর্থরাজনৈতিক বিকাশের জন্যে ইংরেজি আদৌ অনিবার্য কোনো ভাষা নয়। সেই ভাষা ছাড়াই দেশ এবং সমাজ এগোতে পারে। কিন্তু ‘পারে না’ বলে ঔপনিবেশিক সমাজ একটি ধারণা গড়ে রেখেছে। তাই মাতৃভাষার স্বাধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করতে হলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কোনো বিকল্প নেই।  মাঝে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিক শিল্পী সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায়, নমিতা ঘোষ,পৌষালি কর এবং বন্দিতা নেওগ। 
এর পরে বক্তৃতা পরিবেশন করেন বিশিষ্ট কবি, গল্পকার, টংলা মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড০ অভিজিৎ চক্রবর্তী। তঁর বলবার বিষয় ছিল ‘ভাষার মানুষ’। তিনি ‘মাতৃভাষা’ ধারণাটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, আসলে আমরা যে পরিবেশে গড়ে উঠি, যে ভাষা নিয়ে বেড়ে উঠি কথা বলি, আবেগ প্রকাশ করি, কাজ চালাই তাই ‘আমার তথা’ আমাদের ভাষা। পৈতৃক বা মাতৃক সূত্রে মেলা ভাষাটাই আমার ভাষা নাও হতে পারে। যাই বলিনা কেন, সেই ভাষা যারাই ব্যবহার করেন তাদের যদি সারাক্ষণ এটা ভুল বলেছো, এটা ভুল লিখেছো ইত্যাদি বলতে থাকি অর্থাৎ ভুল বের করতে থাকি তবে একটা ভাষা ব্যবহারে লোকে কুণ্ঠিত বোধ করতে পারে, এবং তাঁর যদি সেই ভাষা ব্যবহার বাদ দিলেও কাজ চলে যায়---সে সেই ভাষা বাদ দিয়ে ‘কাজের ভাষা’ গ্রহণ করে ফেলতে পারেন। তিনি বলেন , আমাদের ভাষিক পরিচয় অন্য আরো বহু পরিচয়ের একটি মাত্র। সেটি দরকারি, কিন্তু তাকে যেন ততটা বড়ও করে না তুলি যাতে প্রতিবেশী ভাষা সম্প্রদায় থেকে পর হয়ে পড়ি। ভাষা ব্যবহারে প্রতিবেশী ভাষার প্রভাবও পড়তেই পারে। পড়তে দিলে ভাষার সম্পদ বাড়ে, না দিলে সেই ভাষা মরে যেতেই পারে। 


তিনি বলেন, লেখার ভাষাতে একটা ‘মান’ রাখার দরকার আছে, নইলে নৈরাজ্যের শিকার হতে হবে---কিন্তু সেই কাজ শিক্ষিত জনের---লেখাপড়া নিয়ে যাদের কাজ। এর পরে তিনসুকিয়া, দুলিয়াযান, ডিগবয়, মার্ঘেরিটা, গুইজান থেকে আসা বিভিন্ন ভাষার কবিরা নিজেদের লেখা কবিতা পড়ে শোনান। তাঁরা ছিলেন যথাক্রমে প্রবীর বসু,শান্তনু সরকার,পার্থসারথি দত্ত , শরিক আহমেদ, নিহারিকা দেবী, গৌতম বরঠাকুর, পূজা দাস, রিন্টূ ভট্টাচার্য , নন্দিতা মুখার্জি প্রমুখ। ঘণ্টা তিনেকের এই অনুষ্ঠানে জনা আশি দর্শক শ্রোতার সমাবেশ শেষ মুহূর্ত অব্দি অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য বজায় রেখেছিল। 
 ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্যে প্রশান্ত ভট্টাচার্য এবং ভানুভূষণ দাসকে আহ্বায়ক করে একটি উপসমিতি গঠন করা হয়েছিল। সেই উপসমিতির হয়ে প্রশান্ত ভট্টাচার্যের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয় সন্ধ্যে ছটায়। গোটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বাচিক শিল্পী ত্রিদিব দত্ত।

SHARE THIS

No. 1 Web Media in North-East India. Maintained and Published by Saiyad Bulbul Jamanur Hoque on behalf of Save Media Solution (A unit of SAVE).

0 comments: